মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১
প্রাককথন
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
শিখণ্ডির কাহিনি ও ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু
কুরুক্ষেত্র – কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষদ্বয়ের মহাযুদ্ধের রণভূমি। রাজা দুর্যোধন কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য সর্বপ্রথমে মহমতি পিতামহ ভীষ্মকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। পিতামহ ভীষ্ম ভয়ঙ্কর পরাক্রমে পাণ্ডবপক্ষের অগণিত সৈন্য সংহার করে অবশেষে অর্জুনের নিক্ষিপ্ত অসংখ্য শরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত শরীরে পরাস্ত হয়ে রথ থেকে পড়ে গেলেন। রথ থেকে পড়া সত্ত্বেও অসংখ্য শর তার শরীরে বিদ্ধ থাকায় তিনি ভূপতিত হোলেন না, তাঁর শরীরটা শরের উপর শায়িতাবস্থায় ভূতলে পতিত হোলো। ভীষ্মকে যুদ্ধে পরাজিত করা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় অথবা মৃত্যু বরণ করা ছিলো সম্পূর্ণভাবে ভীষ্মের ইচ্ছাধীন। তবুও ভীষ্ম নিজেকে নিরস্ত্র কোরে পরাজয় বরণ করলেন অর্জুনের কাছে, শুধুমাত্র অর্জুনের রথে শিখণ্ডির উপস্থিতির কারণে।
মহমতি ভীষ্ম ছিলেন বহুদর্শী। সুদীর্ঘ জীবনে অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন দেশের রাজপরিবার, তাদের পারিবারিক ও শাসন ব্যাবস্থার খবরাখবর রাখা এবং কুরুরাজ্য রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ভীষ্ম বিবাহ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাশীরাজ কাশ্যের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে আসেন। ওই তিন রাজকন্যার মধ্যে অম্বা মহারাজ শল্যকে ভালোবাসতেন এবং মনে মনে পতিত্বে বরণ করেছিলেন।
ভীষ্ম ওই তিন রাজকন্যাকে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দিতে উদ্যোগী হওয়ায় অম্বা তাঁর শল্যের প্রতি প্রণয় ও তাকে মনে মনে পতিত্বে বরণ করার কথা ভীষ্মকে বলায়, ভীষ্ম তাঁকে সসম্মানে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পরে অম্বা শল্যের কাছে গিয়ে তাঁর মনোবাসনা ব্যক্ত করায়, ভীষ্ম তাঁকে স্পর্শ করে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণে শল্য তাঁকে বিবাহ করতে অস্বীকার করেন। এইভাবে শল্যের কাছ থেকে আশাহত হওয়ায় অম্বা তাঁর এই পরিণতির জন্য ভীষ্মকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন এবং ভীষ্মকে বধ করবেন বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন।
অম্বা জানতেন যে, অসীম পরাক্রমশালী ভীষ্মকে বধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি ভীষ্মের অস্ত্রগুরু পরশুরামের শরণাপন্ন হোয়ে সমস্ত ঘটনা বিবৃত কোরে তাঁর এই পরিণতির জন্য ভীষ্মকে বধ করার প্রার্থনা করলেন। অম্বার কথায় পরশুরাম সম্মত হোয়ে ভীষ্মের সঙ্গে যু্দ্ধে প্রবৃত্ত হোলেন। কিন্তু, সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও তিনি অপরাজেয় ভীষ্মকে বধ করা তো দূরস্থান, পরাজিত করতেও সমর্থ হোলেন না।
পরশুরামের ব্যর্থতায় বিফল মনোরথ হয়ে, ভীষ্মকে বধ করার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য অম্বা মহাদেবের তপস্যা শুরু করলেন। তপস্যায় সন্তুষ্ট হোয়ে মহাদেব অম্বাকে দর্শন দিলে, অম্বা ভীষ্মকে বধ করার জন্য বর প্রার্থনা করলেন। মহাদেব অম্বাকে বললেন, ভীষ্ম অবধ্য কারণ ভীষ্মের মৃত্যু তাঁর ইচ্ছাধীন। তবে, আমি বর দিচ্ছি – তোমার পরজন্মে তুমিই হবে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ এবং এই জন্মের স্মৃতি তুমি ভুলে যাবে না।
মহাদেবের কাছে বর পাওয়ার পরে অম্বা প্রাণত্যাগ করেন এবং পরে দ্রুপদ রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করলেও, দ্রুপদ তাঁকে পুত্র বলেই প্রচার করেন এবং নামকরণ করেন শিখণ্ডি। শিখণ্ডি বয়ঃপ্রাপ্ত হোলে, তাঁকে পুত্র সাজিয়ে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে দ্রুপদ তাঁর বিবাহ দিলেন। বিবাহের অব্যবহিত পরেই শিখণ্ডির নারীত্ব তাঁর স্ত্রীর কাছে প্রকাশিত হওয়ায়, তাঁর স্ত্রী পিতা দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কাছে শিখণ্ডির নারীত্বের কথা জানিয়ে প্রতিকার চাইলে, হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের রাজ্য এবং দ্রুপদকে বিনাশ করবেন বলে হঙ্কার দেন। এই খবর জানতে পেরে শিখণ্ডি মনের দুঃখে বনে গমন করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে স্থুণাকর্ণ নামে এক দয়ালু যক্ষের দেখা হোলে, স্থুণাকর্ণের জিজ্ঞাসায় শিখণ্ডি সমস্ত ঘটনার কথা বলেন। সবকিছু শোনার পর স্থুণাকর্ণ দয়াপরবশ হোয়ে শিখণ্ডিকে তাঁর পুরুষত্ব দান করেন এবং শিখণ্ডির নারীত্ব গ্রহণ করেন।
ভীষ্ম কখনও কোনো নারী, নারীরূপী পুরুষ অথবা পুরুষের বেশে নারীর উপর অস্ত্র প্রয়োগ করতেন না। শিখণ্ডির এই নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে মহামতি ভীষ্ম সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। সেইজন্য তিনি যুদ্ধকালিন অর্জুনের রথে শিখণ্ডিকে দেখে অস্ত্রবর্ষণ বন্ধ করেন।
অর্জুন কর্তৃক বাণবিদ্ধ হোয়ে শরশয্যায় শায়িত থেকে ভীষ্ম অপেক্ষা করতে থাকলেন সূর্যের উত্তরায়ণ থেকে যাত্রা শুরুর জন্য। সূর্যের উত্তরায়ণ থেকে যাত্রা শুরুর সময় হোলো অত্যন্ত পূণ্যলগ্ন, যে সময় ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু বরণ করবেন।
______________
(ক্রমশ)